স্টাফ রিপোর্টার, বান্দরবান: বান্দরবানে প্রতাগত নেতৃবুন্দ ও সর্বসাধারণের মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সকাল ১০ টায় বঙ্গবন্ধু মক্তমঞ্চের সামনে এ মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ শাসনবিধি বাতিল করার ষড়যন্ত্র ও আদিবাসীদের অধিকার হরণের প্রতিবাদে এ মানববন্ধন করে বান্দরবানের প্রতাগত নেতৃবুন্দ ও সর্বসাধারণ। জেলার প্রতাগত নেতৃবুন্দ ও বসবাসরত ১১ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নারী পুরুষ ব্যানার নিয়ে মানববন্ধনে অংশগ্রহন করে এ প্রতিবাদ জানাই। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলায় প্রতাগত ও ঐতিহ্যগত শাসন ব্যবস্থার পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ আইন বহাল রাখার দাবিতে বিভিন্ন দাবি সংবলিত প্লেকার্ড প্রদর্শন করে। অপরদিকে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় এর প্রতিবাদে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করে প্রতাগত নেতৃবুন্দ ও সর্বসাধারণ।

            এ মানববন্ধনে সঞ্চালনা করেন হেডম্যান মংনু মারমা। এ সময় বক্তব্য রাখেন হেডম্যান এসোশিয়েশন সভাপতি হ্লাথোয়াইহ্রী মারমা, সাধারণ সম্পাদক হেডম্যান উনিহ্লা মারমা, হেডম্যান পারিং ম্রো, মানবাধিকার কর্মী অংচমং মারমা ও প্রতাগত নেতৃবৃন্দ।

            মানববন্ধন শেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অ্যাটর্নি জেনারেলের রীতি বিরুদ্ধ ভূমিকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ এ অন্তর্ভুক্ত আদিবাসীদের বিশেষ অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন প্রতাগত নেতৃবুন্দ। এ স্মারকলিপি সরকারের মাধ্যেম হয়ে গ্রহন করেন জেলা প্রশাসক ডেপুটি কমিশনার ডিসি।

            স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ যা হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়াল নামে পরিচিত। যেটি কিনা ১৯ জানুয়ারী ১৯০০ সালে কার্যকর হয়। তারপর থেকে এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসন সংক্রান্ত প্রধান আইনী দলিল হিসেবে কাজ করে চলেছে। পাশাপাশি এ প্রবিধানে বিভিন্ন বিধানসমূহ রয়েছে যা এ অঞ্চলের সুশাসন, ভুমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং এ অঞ্চলের জনসাধারণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুরক্ষা এবং আন্ত:প্রজন্মগত চর্চার জন্য অপরিহার্য। এ আইন বিষয়ে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০০৩ সালে বিএনপি সরকার আমলে হাইকোর্টের একটি বিভাগীয় বেঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ এ আইনকে একটি মৃত আইন ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে এ প্রেক্ষিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শুনানি শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ এ আইনকে একটি সম্পুর্ণ জীবিত ও বৈধ আইন হিসেবে বলবৎ রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ আইন বহাল রাখার সুপারিশ ও এ আইনের বিভিন্ন বিষয়ে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়।

            পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০: পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ (১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের আইন-১) যা পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল নামেই অধিক পরিচিত। এটি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি আইন যা মূলত বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে কীভাবে পরিচালনা করতে হবে সেই সংক্রান্ত নীতিমালা নিয়ে তৈরি। ১৮৬০ সালে গৃহীত পূর্ববর্তী আইনটি যথেষ্ট নয় সরকারের এই উপলব্ধি থেকেই সেই আইনের জায়গায় এই আইনটি গৃহীত হয়েছিল।

             [১] আইনটি গ্রহণের পর থেকে এটিতে বর্ণিত নির্দেশনা অনুযায়ীই পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসনকার্য পরিচালিত হতো। ১৯০০ সালের ৬ই জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনে গভর্নর জেনারেল সম্মতি প্রদান করেন এবং খবরটি একই বছরের ১৭ই জানুয়ারি কলকাতা গেজেটে প্রকাশিত হয়। নতুন রেগুলেশনটি ১৯০০ সালের মে মাস থেকে কার্যকর হয়। এতে নিয়ন্ত্রকের পুরোনো পদটি ফিরিয়ে আনা হয় এবং পূর্ববর্তী সকল নিয়ম বাতিল করা হয়। ১৯২০ সালে রেগুলেশনটি সংশোধন করে নিয়ন্ত্রককে জেলা প্রশাসক হিসাবে পুনর্বহাল করা হয় এবং নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব গভর্নর এবং তাঁর কার্যনির্বাহী পরিষদের উপর অর্পিত হয়। এর আগে ১৮৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশ বাহিনীর জন্য কার্যকর প্রশাসন গঠনের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার (সীমান্তবর্তী) পুলিশ রেগুলেশন গৃহীত হয়। এই বাহিনীটি ছিল প্রায় একচেটিয়াভাবে উপজাতীয় লোকদের সমন্বয়ে গঠিত।

                [২] এই ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশনও পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়ালের একটি অংশ হয়ে যায়।          পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়ালটির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল: পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন অ-পাহাড়ী ব্যক্তি (পার্বত্য এলাকায় বসবাস করেন না এমন ব্যক্তি) প্রবেশ করতে পারবেন না, যদি না তিনি জেলা প্রশাসকের (ডিসি) বিবেচনার ভিত্তিতে প্রদত্ত অনুমতিপত্রের মালিক হন। জেলার আদিবাসী (অবাঙালি) নয় এমন কোন ব্যক্তি জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তরায়/ ক্ষতিকারক বলে প্রমাণিত হলে জেলা প্রশাসক সেই ব্যক্তিকে বহিষ্কার করার অধিকার রাখেন। আইনজীবিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোনও আদালতে হাজির হওয়া নিষিদ্ধ। ভবিষ্যতে কাউকেই ২৫ একর (১০ হেক্টর) এর বেশি পরিমাণ জমি রাখার অনুমতি দেওয়া হবে না (এক ইজারার অধীনে কিংবা একাধিক ইজারার অধীনে)। এবং ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে জমি কেবল পাহাড়ি পুরুষদেরই দেওয়া যেতে পারে। তবে কোন অ-পাহাড়ী কৃষক যদি কোন পাহাড়ি গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হন তবে তাকে ঐ গ্রামে ইজারা দেওয়া যেতে পারে।

            রাজস্ব গ্রহণ ও অন্যান্য সাধারণ কারণে সৃষ্ট দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারকার্য পরিচালনা জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হল। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসককে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদের অধিকারী করা হলো এবং যেকোন দেওয়ানি ফৌজদারি মামলার আসামি, রাজস্ব এবং অন্যান্য সকল বিষয়ের অভিযুক্ত নাগরিকদের বিচারকার্য পরিচালনার ভার তাঁর উপরেই ন্যস্ত থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি দায়রা আদালত এবং কমিশনারকে দায়রা জজ এর দায়িত্ব দেয়া হল।

            ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির কোড অনুসারে মামলায় ফাঁসির দন্ড প্রদানের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার উচ্চ আদালতের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী হবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যরত সকল কর্মকর্তাগণ জেলা প্রশাসকের অধীনস্থ থাকবেন। যিনি সেখানকার যেকোন কর্মকর্তার যেকোন আদেশ সংশোধন করার জন্য অনুমতি প্রাপ্ত হলেন। আর জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন আদেশ সংশোধন করার জন্য কমিশনারকে অনুমতি দেয়া হল। এই রেগুলেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য স্থানীয় সরকার নতুন আইন তৈরি করতে পারবেন। নিবন্ধকরণ আইন-১৯০৮ পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। রেগুলেশনের ১২-৩৩ নং বিধিসমূহ নিবন্ধকরণ আইনের নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে নিয়ে রচিত।

                [৩] তিনটি সার্কেলের তিন জন সার্কেল প্রধানকে তাদের নিজ নিজ সার্কেলের প্রশাসনের জন্য নিযুক্ত করা হবে। একটি সার্কেলে বসবাসকারী বা চাষাবাদকারী প্রত্যেক ব্যক্তি সরকারী কর্মকর্তা, তার পরিবার, ব্যবসায়ী ও বাজারের দোকানদারদের নিকট দায়বদ্ধ না থেকে বরং সার্কেল প্রধান বা রাজার এখতিয়ারের অধীন থাকবেন। হেডম্যানরা মৌজা (একটি জেলার রাজস্ব আদায়ের ক্ষুদ্রতম একক) প্রশাসনের নিকট দায়বদ্ধ থাকবেন এবং তারা উপ-বিভাগীয় কর্মকর্তা, সার্কেল প্রধান বা রাজা এবং মৌজার বাসিন্দাদের পরামর্শে ডেপুটি কমিশনার ডিসি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। হেডম্যানের সুপারিশ ব্যতীত কোন জমি সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি বা হস্তান্তর করা যাবে না।

                [৪] পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি দুটি মহকুমা (রাঙামাটি এবং রামগড়) এ বিভক্ত ছিল। এবং এদের প্রত্যেকটিকে উপ-বিভাগীয় কর্মকর্তার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। তবে ১৯৫২ সালে বান্দরবান একটি মহকুমা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং ১৯৮১ সালে এটিকে একটি জেলা করা হয়। ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে রামগড় মহকুমার সদর দপ্তর রামগড় থেকে খাগড়াছড়িতে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে সেটিকেও জেলা করা হয়। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম তিনটি জেলায় বিভক্ত হয়ে যায়।

            [৫] জেলা প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে ডেপুটি কমিশনার ডিসি সার্কেল প্রধানদের সাথে পরামর্শ করতে হত। এই উদ্দেশ্যে বছরে কমপক্ষে দু’বার ডেপুটি কমিশনার ডিসি সভাপতিত্বে একটি সভার আয়োজন করা হত। যেখানে সার্কেল প্রধান বা তাদের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হতো।

            পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা ১৯০০ ম্যানুয়ালটি প্রয়োগের ফলাফল[: এ ম্যানুয়ালটি কার্যকর করার ফলে রানী কালিন্দীর নির্মিত পুরানো তালুকগুলি (একটি নির্দিষ্ট প্রশাসনিক অঞ্চল) বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল এবং সার্কেলগুলিকে মৌজা সীমানা দিয়ে বিভক্ত করা হয়েছিল। এরপর একজন হেডম্যানকে একটি মৌজার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল। একজন কারবারি (গ্রাম প্রধান) একটি গ্রামের দায়িত্বে থাকতেন এবং বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি মৌজা গঠন করা হয়েছিল। প্রত্যেক হেডম্যান নিজ মৌজার জুম চাষীদের থেকে খাজনা আদায় করে সার্কেল প্রধানকে প্রদান করতেন। সার্কেল প্রধান খাজনা সংগ্রহের পরে উপ-বিভাগীয় কর্মকর্তা বা ডেপুটি কমিশনার ডিসি নিকট চাষাবাদ বাবদ খাজনা বা জুম খাজনা প্রদান করতেন। সার্কেল প্রধানের নিজস্ব বিনিয়োগকারীরা বাংলা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতেন।

Act-1900-20240709003

খবরটি 474 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen