বিশেষ খবর ডেস্ক: ঢাকায় ইউপিডিএফ আয়োজনে গোলটেবিল আলোচনা করা হয়। শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সকাল ১১ টায় ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হল রুমে ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর উদ্যোগে গোলটেবিল আলোচনা আয়োজন করা হয়েছে। এ আয়োজিত “পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম এবং জনগণের অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি উপস্থিত ছিলেন আনু মুহম্মদ। দেশের অন্যান্য জায়াগার মত পার্বত্য চট্টগ্রামেও পুরো ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে। সে জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আগের সরকারের ধারাবাহিকতা ছিন্ন করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক রুপান্তর করতে হবে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ইউপিডিএফ প্রস্তাবিত ৭দফা দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। ১৯৯২ সালে লোগঙ গণহত্যার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছে এখনো পর্যন্ত তার একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সে দাবিগুলোর মধ্যে অধিকাংশ দাবি এই ৭ দফায় রয়েছে। অনেক সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পাহাড়িদের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে লক্ষ পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িরা অংশগ্রহণ করলেও স্বাধীনতা পরবর্তীতে পাহাড়িদের অধিকার অর্জিত হয়নি। শেখ মুজিব পাহাড়িদের বাঙালি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে সমস্যার উদ্ভব হল। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্ট বসিয়ে দিয়ে সেনাশাসন জারি করে গণহত্যা শুরু হল। ‘৯২ সালে লোগঙ গণহত্যা হল, এরপর ১৯৯৭ সালে ‘‘শান্তি চুক্তি” হল। চুক্তির পরও পাহাড়ে সমস্যার সমাধান হল না কেন, তা অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি অধিকার, জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি এবং সামরিক শাসনের সমস্যার সমাধান হয়নি।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, সেনাশাসনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত খবর বাংলাদেশে আসছে না। পাহাড়ে অর্থনৈতিক পরিবর্তন রুপান্তর এসেছে। দেশী-বিদেশি পুঁজি, পর্যটন ইত্যাদি সেখানে দেখা যাচ্ছে। সেনাশাসনের ফলে সেখানকার প্রকৃত খবর বাংলাদেশে আসছে না, আমরা জানি না। গোপনে অনেক পাহাড় দখল হয়ে গেছে, সামরিক-বেসামরিক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা পাহাড় দখল করে আছে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সেটলার প্রসঙ্গে বলেন, সেটলার বললে অনেকে আপত্তি তুলেন বা অপমানজনক মনে করেন। সেটলার শব্দটা এসেছিল সরকারী উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটলার কর্মসূচির কারণে। জিয়াউর রহমানের আমলে পরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশে গরিব ছিন্নমূল বাঙালিদের খাদ্য, জমি ইত্যাদি দেবে বলে সামরিক বাহিনী প্রকল্পের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে একটা ঢালের মত সেনাবাহিনী ক্যাম্পের আশে পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকে পাহাড়ি-বাঙালি কৃত্রিম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কার হাতে আছে, কারা দখল করেছে সে তালিকা প্রকাশ করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানান। পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কি কি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, কিভাবে ব্যয় হয়েছে সে সকল বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। অধ্যাপক আনু মুহম্মদ সংবিধান সংস্কার কমিশনকে জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি মৌলিক বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্ব সহকারে দেখার আহ্বান জানান। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল গণহত্যার বিচারসহ সম্প্রতি রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৪ জনকে হত্যার ঘটনায় গণতদন্ত কমিশন গঠন করার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান।
ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, পাহাড়ে পর্যটন স্থাপন করে ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা সংকটময় করা হচ্ছে। ফলে কিছু দিন আগে সেখানে ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতি আমরা দেখতে পেয়েছি। প্রান্তিক মানুষের বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে কোটা ব্যবস্থা প্রয়োজন।
আইনগত বিষয় তুলে ধরে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ১৯০০ সালের রেগুলেশনের ৪ নং ধারায় বলা আছে বাংলাদেশে কোথাও একটা আইন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং সেটি যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় প্রযোজ্য হয় সেটি অনুমোদন নিয়ে করতে হবে।
মোশরেফা মিশু বলেন, পাহাড়িদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দরকার তা দেশের অনেক রাজনৈতিক দল স্বীকার করতে চায় না। ৫ আগস্ট দেশে গণঅভ্যুত্থান হওয়ার পরও কেন পাহাড়ে রক্ত ঝড়ছে, ৪ জন পাহাড়ি খুন হল তা আমি প্রশ্ন রাখতে চাই। পাহাড়ে হত্যাকাণ্ড ঘটনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পক্ষ থেকে আমরা কোন বিবৃতি দেখতে পাইনি। আমি ধিক্কার জানাই এবং ১৯-২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে আহ্বান করছি। তিনি আরো বলেন, যে বৈষম্যহীন দেশে শ্রমিক ভাইকে গুলি করা হয়, পাহাড়ি ভাইদের হত্যা করা হয়, সে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র আমরা চাই না।
ফয়জুল হাকিম বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ঘটলেও তার দোসর সরকারি বেসরকারি আমলারা এখনো ক্ষমতায় বসে আছে। আমরা নতুন সংবিধানের কথা বলছি, সে সংবিধানে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ, জাতিসত্তার জনগণ, সকল ভাষার মানুষের অধিকার থাকবে। কিন্তু এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সে বিষয়ে কোন উদ্যোগ দেখতে পাই না। তিনি আরো বলেন, আধুনিকায়নের নামে প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র ধ্বংস করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন স্থাপন করা যাবে না। সেখানকার জাতিসত্তাদের উচ্ছেদ করে সংস্কৃতি ধ্বংস করা যাবে না। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অলিখিত সেনা শাসন প্রত্যাহার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর আরোপিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে “১১ দফা” নির্দেশনা বাতিল এবং ১৯-২০ সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচারের দাবি জানান।
সাইফুল হক বলেন, ৫ আগস্টের পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এখনো কোন পরিবর্তন হয়নি। পাহাড়ে হামলার ঘটনার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়া আর আসা ছাড়া কোন কার্যকর ভূমিকা আমরা দেখতে পাই না। সরকারে পক্ষ থেকে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তার উপরে আমাদের কোন আস্থা নেই। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক ঘটনা একটি গণতদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দিন যাবৎ একটি চক্র দ্বন্দ্ব, সংঘাত জিইয়ে রেখেছে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন হওয়া দরকার।
মাসুদ রানা বলেন, সেনাবাহিনী উপস্থিত থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হবে না। সে কারণে পাহাড়ে সেনাশাসন প্রত্যাহারের রোডম্যাপ থাকা উচিত।
আলোচনার শুরুতে ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম এবং জনগণের অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো:
১) অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার করতে হবে এবং বেসামরিকায়ন করে সেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সকল দল ও সংগঠন স্বাধীনভাবে তাদের গণতান্ত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
২) স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদানপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে সংস্কার করতে হবে, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয় পরিচয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়।
৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা ও সেটলার পুনর্বাসনকে একত্রে বিবেচনাপূর্বক একে একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং রাজনৈতিকভাবে তার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে; এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে পাহাড়িদের কাছ থেকে বেদখলকৃত জমি ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি সেটলারদেরকে জমি বা জীবিকাসহ অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) জাতীয় সংবিধানে পাহাড়িদের জাতিসত্তা ও ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে; পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং জাতীয় সংসদে সাধারণ আসন ছাড়াও তাদের জন্য একটি নারী আসনসহ ৪টি আসন সংরক্ষণ করতে হবে।
৫) ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলসহ স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ ও কল্পনা চাকমার অপহরণ ও গুমসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত ও বিচার করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের সহায়তায় ও অংশগ্রহণে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হামলার ঘটনারও অনুরূপভাবে তদন্ত ও বিচার করতে হবে।
৬) তথাকথিত সীমান্ত সড়ক ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্টকারী সকল সরকারী ও বেসরকারী প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
৭) সরকারী চাকুরীতে ও সকল সরকারী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে পাহাড়িদের জন্য ৫% কোটা পুনর্বহাল করতে হবে।
গোলটেবিল আলোচনা সভায় ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমার পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. হারুনুর রশিদ, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি সাইফুল হক, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, মানবাধিকার কর্মী স্বপন আদনান প্রমুখ।
এসময় সংহতি জানিয়ে উপস্থিতি ছিলেন নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা সমন্বয়ক জাফর হোসেন, বাঙলাদেশ লেখক শিবিরে সম্পাদক কাজী ইকবাল, বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতা সুশান্ত সিনহা, বাংলাদেশে সাম্যবাদী দল (এমএল) এর সাধারণ সম্পাদক ডা. হাকিম, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্য সমন্বয়ক মফিজুর রহমান লাল্টু, গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক সালমান সিদ্দিকী, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, লেখক ওমর তারেক চৌধূরী, চলচিত্রাকার আকরাম খান, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি ইকাবল কবির, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি নজির আমিন চৌধূরী জয়, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনে সহ-সভাপতি দীপা মল্লিক, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নীতি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা, ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রমোদ জ্যোতি চাকমা, এক্টিভিস মার্জিয়া প্রভা প্রমুখ।