Date: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
পানছড়িতে শহীদ বিপুল, সুনীল, লিটন ও রুহিন’র স্মরণসভা ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন
পানছড়ি উপজলায় ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ও সামাজিকভাবে দালাল বয়কটের কর্মসূচি ঘোষণা
খাগড়াছড়িতে পানছড়িতে গত ১১ ডিসেম্বর সেনা মদদপুষ্ট ঠ্যাঙারে নব্যমুখোশ সন্ত্রাসীদের হামলায় শহীদ বিপুল চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন ত্রিপুরার স্মরণসভা সম্পন্ন হয়েছে। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) পানছড়ি ইউনিট এই স্মরণ সভার আয়োজন করে। বুধবার (২০ ডিসেম্বর ২০২৩) সকালে পানছড়ি উপজেলার জগপাড়া এলাকার একটি মাঠে পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় পার্টি পতাকা অর্ধনমিত করে সাইরেন বাজিয়ে শহীদদের সর্বোচ্চ সম্মান জানানো হয়েছে।
“শহীদের রক্ত স্নানে পানছড়ি হবে দালাল মুক্ত, সরকারপন্থী চর, গণশত্রু, খুনীদের হটাও” আহ্বান সম্বলিত এ অনুষ্ঠানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠনের অতিথি, এলাকার জনপ্রতিনিধি, কার্বারি, হেডম্যান, মুরুব্বীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তিন সহস্রাধিক লোক অংশগ্রহণ করেছেন। মূল ব্যানারের দু’পাশে স্থাপিত ফেস্টুন দু’টির ক্যাপশন হচ্ছে ‘মরতে যখন শিখেছি, কেউ আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না!’ ‘লড়াইয়ে এগিয়ে আসুন, বিজয় অর্জনে সাহসী হোন!’ অনুষ্ঠানের শুরুতে সকাল এগারটার দিকে একটি চৌকস দল দৃপ্তপদে এগিয়ে নির্ধারিত স্থানে পার্টি পতাকা উত্তোলন করে স্যালুট দেয়। এ সময় শিশু বাদক দলের ব্যান্ডে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ সুর বেজে ওঠে, মঞ্চে পার্টি ও গণফ্রন্টের শিল্পীবৃন্দ কোরাস গায়, সাউন্ডবক্সেও তা বাজানো হয়। এরপর শহীদদের সম্মান জানাতে পার্টি পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। এ সময় এক মিনিট ধরে সাইরেন বেজে উঠলে পুরো এলাকা কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।
শহীদ বিপুল-লিটন-সুনীল ও রুহিনসহ এযাবৎকালে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিভিন্ন সময়ে নিহত পার্টির সকল শহীদ, স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেন-ডা. মিলন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্যাতনে নিহত শহীদ সহ বিশ্বে নিপীড়ত জনগণের মুক্তির লড়াই যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাদের সম্মানে অবনত মস্তকে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। স্মরণসভায় অংশগ্রহণকারীগণ কালো ব্যাজ ধারণ করেন। অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্বপালনকারীরা কাল আর্মব্যান্ড ও ক্যাপ পরিহিত ছিলেন। ক্যাপ-এ অঙ্কিত ‘বিজয় অর্জিত না হলে, ঘরে ফিরবো না’ এ শ্লোগানে স্বেচ্ছাসেবকগণ ছিল সবাই উদ্দীপ্ত। নিরবতা পালন শেষে শহীদদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে সম্মান জানানো হয়। ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফভুক্ত সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ, দেশের প্রগতিশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, জনপ্রতিনিধিবৃন্দ ও এলাকার জনগণ স্বউদ্যোগে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। স্বেচ্ছাসেবকগণ স্মরণসভায় উপস্থিত সকলকে আন্দোলনের সাথে একাত্মতার নিদর্শন হিসেবে ডান হাতে লাল রিবন পরিয়ে দেয়। মঞ্চে শহীদ পরিবারদের সাথে পার্টি, আমন্ত্রিত অতিথি ও গণফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ উঠে দাঁড়িয়ে সংহতি জানান।
স্মরণসভা থেকে দালালদের প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং দালালদের সামাজিকভাবে বয়কটের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে দালালদের আত্মসমর্পণের সময় সীমা বেঁধে দেওয়া হয় এবং ২৭ ডিসেম্বর চেঙ্গীনদীতে কুশপুত্তলিকা ভাসিয়ে দেয়া ও ৩১ ডিসেম্বর লড়াই সংগ্রামের সাফল্য কামনায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয় । এছাড়া আগামী ১০ এপ্রিলের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধ লড়াইয়ের বীরদের অবমাননাকারী তথাকথিত লেখকদের লেখা প্রত্যাহারের আহ্বানসহ এলাকার জনগণের প্রতি দালাল বয়কট সংক্রান্ত বেশ কিছু আহ্বান জানানো হয়েছে।
সভায় চার শহীদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের সমবেদনা জানিয়ে ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার প্রেরিত শোক বার্তা স্মরণসভায় পড়ে শোনানো হয়। বার্তাটি পড়ে শোনান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য রিপনা চাকমা। শোক বার্তায় তিনি বলেন, ‘শারীরিকভাবে হত্যা করে শহীদ বিপুল-লিটন-সুনীল ও রুহিনদের সহযোদ্ধাদের ভীত সন্ত্রস্ত করা যায় না। যেমন করা যায়নি শহীদ বিপুল-সুনীলকে, কারামুক্তির পর দু’জনেই পূর্ণউদ্যমে যুক্ত হয়েছিলেন সংগঠনে। তাদের প্রাণনাশে দমে না গিয়ে দ্বিগুণ ক্রোধ ও সাহসের সাথে শত শত সহযোদ্ধা ও সহস্র জনতার রাজপথে নেমে আসা, ফুল দিয়ে সম্মান জানানো এবং দাহক্রিয়ায় অংশগ্রহণ– এ সত্যতারই প্রমাণ দেয়। শহীদ বিপুল-লিটন-সুনীল ও রুহিনের আরাধ্য মহান কাজ সম্পন্ন করতে এভাবে আরও শত শত সহযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে এগিয়ে আসবেন। তাদের মৃত্যুর সার্থকতা এখানেই! এতে তিনি আরো বলেন, ‘আজ তারা শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু চির অম্লান থাকবেন আমাদের স্মৃতিতে। তাদের শহীদানে প্রিয়জন হারানোর বেদনা সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন করলেও আমাদের সহযোদ্ধারা ভেঙ্গে পড়ে না, অর্পিত দায়িত্বের কথা ভুলে যায় না। তাদের মৃত্যু লড়াই সংগ্রাম এগিয়ে নিতে আমাদের সবাইকে আরও বেশি দায়িত্ব সচেতন, দৃঢ় প্রত্যয়ী ও অঙ্গীকারবদ্ধ করে তোলে!’
স্মরণসভায় ইউপিডিএফ সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সভার সঞ্চালক সুমেন চাকমা। এ দীর্ঘ বক্তব্যে রবিশংকর চাকমা বলেন, গত ১১ ডিসেম্বর রাতে একটি বিশেষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লেলিয়ে দেয়া ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা পানছড়ির অনিল পাড়ায় বিপুল, সুনীল, লিটন ও রুহিনকে ঠাণ্ডা মাথা নৃশংসভাবে খুন করে। এই বর্বর ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ পার্বত্য চট্টগ্রাম তো বটে, পুরো দেশকে স্তম্ভিত করেছে। এর বিরুদ্ধে এখনো নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাচ্ছে। ভারতের একটি সংগঠন হামলার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চার সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার জন্য জাতিসংঘ ও আমেরিকার কাছে আবেদন জানিয়েছে। যার সামান্যতম মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ আছে সে কখনই এই বর্বরতম নরহত্যাকে সমর্থন করতে পারে না। সভায় প্রেরিত লিখিত বার্তায় তিনি আরো বলেন, বিপুল, সুনীল, লিটন ও রুহিন এখন অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা, হার না মানা প্রতিবাদী তারুণ্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এখন সুস্পষ্ট দু’টি ধারা বিদ্যমান। একটি হচ্ছে সুবিধাবাদী, আপোষকামী, পরাজয়বাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারা। এরা অধিকারহারা নিপীড়িত জনগণের পক্ষে লড়াই না করে শাসকগোষ্ঠীর সাথে নির্লজ্জভাবে আপোষ করেছে, সরকারের লেজুড়বৃত্তি ও পদলেহন করছে এবং আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করছে। সে কারণে আপামর জনগণের কাছে তারা নিন্দিত ও ধিকৃত। লিখিত বক্তব্যে ইউপিডিএফ নেতা বলেন, বিপুলদের হত্যার পর ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ও তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে সর্বত্র নিন্দা ও ধিক্কার উচ্চারিত হচ্ছে। অনেকে প্রতিশোধ নেয়ার প্রবল ইচ্ছাও ব্যক্ত করছে। এটাই স্বাভাবিক এবং তা আমাদের মধ্যে আশাবাদ শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। যে নিপীড়িত জাতি ও জনগণ তার শত্রুর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে না, সে জাতি ও জনগণ তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে না, আর সংগ্রাম করে না বলে তারা অধিকার অর্জন করতে পারে না, বিজয় অর্জন করতে পারে না। তিনি বলেন, পানছড়ি হলো সংগ্রামী বীরদের ঘাঁটি। শহীদ প্রদীপ লাল, কুসুমপ্রিয়, দেবোত্তম, কাতাং ত্রিপুরা (শহীদ সুনীল ত্রিপুরার ভাই), হৃদয়সহ আরও অনেক শহীদ এই মাটিরই সন্তান। তারাও বিপুল-সুনীলদের মতো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এজন্য পানছড়িবাসী বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে পারেন। তারা বলতে পারেন বীরদের পূণ্যভূমি পানছড়ি দালাল প্রতিক্রিয়াশীলদের কোন স্থান হতে পারে না। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, যারা মনে করে খুন, ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাস করে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলন দমন করা যাবে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। চুক্তির পর থেকে আজ পযন্ত আমাদের পার্টির ৩৫৬ জন নেতা কর্মী ও সমর্থককে হত্যা করা হয়েছে, নিষ্ঠুর দমন পীড়ন চালানো হয়েছে ও এখনো হচ্ছে, কিন্তু তারপরও আন্দোলন ধ্বংস করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। আমরা যে রক্ত দিয়েছি, তার মূল্যে জনগণের অধিকার দিতেই হবে।
সভায় জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নেতা ভূলন ভৌমিক বলেন, ঐক্যের কথা বলা যায়, কিন্ত দালালদের সাথে ঐক্য কখনো সম্ভব নয়। বিপুল-সুনীলদের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা নিপীড়িত জনগনের সাথে ঐক্য চাই পার্বত্য চট্টগ্রামের দালালদের গণ আদালতে বিচার করতে হবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা তার বক্তব্যে পানছড়ি উপজেলায় আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন এবং বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। আমরা গত ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ বিপুলদের হারিয়েছি। সে কারণে আগামী ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাই। তার এ ঘোষণা উপস্থিত জনতা তুমুল করতালি ও শ্লোগান দিয়ে তা সমর্থন দেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, পুজগাঙের ঘটনার পরে বিজিবিকে বয়কট করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণ তাদেরকে পানি খেতে দেয়নি। পানছড়ি উপজেলা সীমান্ত সড়ক তৈরি করে পাহাড়িদের হয়রানি করায় তীব্র উষ্মা প্রকাশ করে তিনি মন্তব্য করেন, মূলত সীমান্ত সড়কের নামে পাহাড়িদের পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘিরে রাখা হয়েছে।
বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন-এর সাবেক সভাপতি আতিফ অনিক বলন, বিপুল চাকমা খুব নমনীয়ভাবে সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিপুলদের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিপুলদের জীবন থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে। আত্মপ্রতিষ্ঠার মোহে আবদ্ধ না থেকে নিজের সর্বস্বকে সংগঠনের কাছে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি পাহাড় ও সমতলের লড়াই সংগ্রামের পথিক তিনি নমনীয়ভাবে অন্যের মতকে গ্রহন করতেন। আত্মত্যাগের মানসিকতা ছাড়া সংগ্রাম বিকশিত করা যায় না। পাহাড়ের আন্দোলনকে স্তব্দ করতে সরকার বিভিন্ন সুযোগসুবিধা প্রলোভন দেখিয়ে সংগ্রামী একটা অংশকে আন্দোলন থেকে দূরে রেখেছে।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক সৌরভ রায় বলেন, ঢাকায় রাজনীতি করার সময় বিপুলদের সাথে দেখা। বিপুল একজন যোগ্য নেতা ছিলেন। রাষ্ট্রীয় মদদে পাহাড়ে বিচার বহির্ভুত হত্যা চলছে। খুন গুম ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে সমতলে প্রচার করা হতো অন্যভাবে। তার রাজনীতির জীবনে গল্প অনেক শুনেছি। বিপুল চাকমা কখনো দুঃখ বুঝতে দেননি। তার মত ব্যক্তিত্ব পাওয়া বিরল। তিনি শুধু পাহাড়ের নেতা নন, সমগ্র বাংলাদেশের নেতা। তিনি বলেন, বিপুলের মত হাজারো বিপুল তৈরী হয়ে গেছে পাহাড়ে। পাহাড় থেকে নব্য দালাল মুখোশদের হটাতে হবে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সমাজের দালাল তাঁবেদার সেনাবাহিনীদের পাহাড় থেকে হটিয়ে বিপুলদের খুনের বদলা নিতে হবে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিপুলদের লড়াইয়ের ইতিহাস ধারন করার ক্ষমতা আমার নেই। বিপুলদের হত্যায় পাহাড় ও সমতলে যে জনমানুষের রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা পাহাড়ে বসে অনুধাবন করতে পারছি। লড়াই সংগ্রামে আরেকটি ঘুর্নিঝড় তৈরী করে শাসককে বুঝিয়ে দিতে হবে। এই রাষ্ট্র মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এদেশ শুধু বাঙালিদের, পাহাড়িদের হতে পারেনি। যে দেশ জাতি অন্য জাতির উপর শোষন করে সে জাতি নিজেই স্বাধীন নয়। এই শোকের বোধের জ্বলে আগুনে স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে হবে।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক দিলীপ রায় বলেন, বিজয়ের মাসে সবাই বিজয় উৎসব পালন করলেও স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও বিজয়ের কোন চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকল জাতিসত্তার মানুষ ভেবেছিল সবাই ভাষার স্বীকৃতি পাবে, জাতির স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু পাহাড় ও সমতলে খুন, গুম, হত্যা, অপহরণ ও শ্রমিক হত্যার ফলে ফ্যাসিস্টে রূপ নিয়েছে। উন্নয়নের নামে জমি বেদখল করে পাহাড়ে শোষণ চলছে। পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে অস্বীকার করে এক ধরনের গণহত্যা চালাচ্ছে। একতরফা নির্বাচন জনগণ মানে না।
শহীদ বিপুলরা আমাদের স্বপ্নসেতু। সংগ্রামের পথ বিপুলরা দেখিয়ে দিয়েছে। বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির মুক্তি সম্ভব। ২০১৬ সালে বিপুলকে দেখেছি। তার মায়ের শোক সভায় ডান্ডাবেরী পরা অবস্থায় দেখেছি। তিনি সব মায়ের নিজের মা মনে করতেন। পুঁজিপতিদের দালাল সংগঠনদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্নে বিপুলরা যেভাবে আপোষহীন ছিলেন সেভাবে বিপুলের আদর্শকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। পাহাড় একদিন মুক্ত হবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, অধিকারহীনতার মধ্যে পাহাড়ের মানুষ বেঁচে আছে। দৃপ্ত শপথ নিয়ে লড়াই করার কথা শুনে উদ্দীপ্ত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পুঁজিপুতিরা ক্ষমতা দখল করেছে। শোষিত শ্রেণীরা এখনও শোষকের যাঁতাকলে পিষ্ঠ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনীর কাজ দেশে যুদ্ধ বাঁধলে তা প্রতিহত করা। কিন্তু অর্ধেক অংশ পাহাড়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সঠিক আদর্শে সঠিক চিন্তায় পাহাড় ও সমতলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অঘোষিত সেনা শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। শহীদের আত্মবলিদান বৃথা যাবে না। ক্ষুদিরাম শিখিয়ে গেছে লড়াই করার প্রত্যেক আন্দোলনে বীররা আত্নবলিদান দিয়েছেন। ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরে শহীদ বিপুলদের আদর্শ বুকে ধারণ করতে হবে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা স্বাগত বক্তব্য প্রদানকালে বলেন, বিপুল চাকমার মতো একজন নেতাকে দেখেছি যে কোন বিষয়ে সব সময় হাসিমুখে উত্তর দিতেন। দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হলে হাসিমুখে স্বীকার করতেন এবং সমালোচনা মেনে নিতেন। তিনি ছিলেন আদর্শবান একজন প্রকৃত সহযোদ্ধা। নিজের দায়িত্বের প্রতি তিনি অবিচল ছিলেন। তার কর্মদক্ষতার কারণে পাহাড়ে শত শত বিপ্লবী ফুল ফুটে উঠেছে। তাঁর অবদান আত্মত্যাগ চিম্বুক পাহাড়ের চেয়েও ভারী। যত দিন চিম্বুক, রুইলুই থাকবে ততদিন পাহাড়ের জনগণ বিপুল, সুনীল, রহিন ও লিটন চাকমাদের কথা মনে রাখবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য যুগেশ্বর ত্রিপুরা বলেন, যারা দালালী করেছে তারা কোনো কালে রেহাই পায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের দালালরাও রেহাই পাবে না। স্বাধীনতা ৫৩ বছর পরেও পাহাড়ে রক্ত ঝড়ছে। পাহাড়িরা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা সৃষ্ট বাহিনী কর্তৃক পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী বিধ্বংসী হত্যালীলা চলছে। গনতন্ত্রমনা ও প্রগতিশীল মানুষ পাহাড় থেকে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে কথা বললেও পাহাড়ে অঘোষিত সেনা শাসন জারি রয়েছে।
বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের চট্টগ্রাম নগরের সংগঠক তিতাস চাকমা তার বক্তব্য বলেন, পাহাড়ের সেটলারদের ব্যবহার করে সেনাবাহিনী ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত করেছে। এখন পাহাড়ে নব্য মুখোশ সৃষ্টি করে জুম্ম দিয়ে জুম্ম হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত। যারা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের মনুষ্যত্ববোধ বলতে কিছুই নেই। তাদেরকে সকলে মিলে প্রতিহত করতে হবে। না হলে পাহাড়কে তারা নেতৃত্ব শুন্য করে ছাড়বে। শহীদ বিপুলের পিতা সুনয়ন চাকমা ছেলের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বিপুল সহযোদ্ধা সহপাঠীদের আপ্যায়ন করতো। ছাত্র জীবনে রাজনীতি করতে দিয়েছি। চাকরি করতে বলায় বিপুল বলেছিল চাকরি করলে পরিবার সেবা করতে পারবো কিন্তু নিপীড়িত মানুষের সেবা করতে পারবো না। আমাদের ছেলে বিপুলরা শহীদ হলেও বেঁচে থাকবে জনমানুষের কাছে।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে ইউপিডিএফ নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা বলেন, একটা দেশের রাষ্ট্র সরকার যখন ফ্যাসিষ্ট চরিত্র ধারণ করে তখন সাধারন জনগণই বেশি নির্যাতিত হয়। পাহাড় সমতলে লড়াই হবে সমানতালে এ শ্লোগানকে ধারন করতে হবে। আমাদের এই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চাই। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারা প্রগতিশীলআর কারা প্রতিক্রিয়াশীল এটা এখন পরিস্কার। জনগণকে সরকারপন্থি দালাল-গণশত্রুদের চিন্থিত করতে হবে। তিনি লোগাঙ গণহত্যা হতে ১১ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডসহ সকল পরিস্থিতি দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলার জন্য পানছড়ি এলাকাবাসীকে ধন্যবাদ জানান।
ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন: সভায় বিপুল চাকমার পিতা সুনয়ন চাকমাকে আহ্বায়ক করে পাহাড়ে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটির পক্ষ থেকে আগমাী ৩১ ডিসেম্বর সকালের মধ্যে দেআনপাড়া-তেঁতুলতলাসহ সেনা-বিজিবি আশ্রয় প্রশয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়গ্রহণকারী সমাজচ্যুত-দালালদের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নিকট আত্মসমর্পণের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এছাড়া দালালদের সামাজিকভাবে বয়কট, সন্তু লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ, দালাল-খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়াসহ বেশ কিছু আহ্বান জানানো হয় এবং দীপংকর, কুজেন্দ্র, বীর বাহাদূরকে জাতীয় বেঈমান ঘোষণা প্রদানসহ আরও বেশ কিছু কর্মসূচিও ঘোষণা দেওয়া হয়।
স্মরণসভা অনুষ্ঠানে শহীদ বিপুল, সুনীল, লিটনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি প্রদর্শন করা হয়। উপস্থিত লোকজন ছবিগুলো দেখে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন।
এদিকে অনুষ্ঠান সফল করতে গতকাল থেকে তিন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক, এলাকার জনগণ অক্লান্তভাবে কাজ করে মাঠ, মঞ্চ ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। স্মরণসভায় সরকারের দালাল কুজেন্দ্র, বীর বাহাদূর, দীপংকর, সন্তু লারমা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়ালের ছবিযুক্ত কুশপুত্তলিকায় জুতার মালা পরিয়ে প্রদর্শন করা হয়। স্মরণসভা শেষে উপস্থিত লোকজনের জন্য মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করা হয়। অপরদিকে, চার শহীদের পরবারবর্গ নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিহারে ও মন্দিরে শহীদদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফ কেন্দ্রীয় সদস্য উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমার সভাপতিত্বে সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি এডভোকেট ভুলন ভৌমিক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি দীপা মজুমদার, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন-এর সাবেক সভাপতি আতিফ অনিক, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক দিলীপ রায়, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি সাইফুর রুদ্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ চৌধুরী, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের চট্টগ্রাম নগরের সংগঠক তিতাস চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক সৌরভ রায়, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর চট্টগ্রাম নগরের সংগঠক সাইফুর জামার রেদওয়ান ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য যুগেশ্বর ত্রিপুরা। এছাড়া মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন পানছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা, উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান চন্দ্রদেব চাকমা, ১নং লোগাং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রত্যুত্তর চাকমা, ৩নং পানছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উচিত মনি চাকমা, ২নং চেঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কালাচাঁদ চাকমা, ১নং লোগাঙ ইউপি চেয়ারম্যান জয় কুমার চাকমা, ২নং চেঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বরুণ চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক সমর চাকমা। এছাড়াও মঞ্চে শহীদ বিপুল চাকমার পিতা সুনয়ন চাকমা, সুনীল ত্রিপুরার পিতা সুখেন্দু ত্রিপুরা, লিটন চাকমার মা মালা চাকমা ও রুহিন ত্রিপুরার স্ত্রী বাজ্জপরাণী ত্রিপুরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইউপিডিএফ সংগঠক সুমেন চাকমা।
বার্তা প্রেরক
নিরন চাকমা
প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।