বিশেষ খবর ডেস্ক: দেশের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মিয়ানমারের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধানসহ ১০ জন গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১১)। মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহীনুর আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রেপ্তারকৃতদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করে তাদের বিরুদ্ধে র্যাব বাদী হয়ে এফআইআর (নং ২৯) দায়ের করেছে। এর আগে গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমিপল্লী আবাসিক এলাকার ভূমিপল্লী টাওয়ার থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছে নগদ ২১ লাখ ৩৯ হাজার ১০০ টাকা, ৪ টি দামি হাতঘড়ি, একটি ধারালো চাকু ও একটি স্টিলের ধারালো চেইন (ধারালো দাঁতযুক্ত ও দুই পাশে হাতল বিশিষ্ট) উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্বার জুনুনী (৪৮), মোস্তাক আহাম্মদ (৬৬), সলিমুল্লাহ (২৭), ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানার চর আলগী এলাকার আতিকুল ইসলামের ছেলে মনিরুজ্জামান (২৪), আসমত উল্লাহ (৪০), মো: হাসান (৪৩), সলিমুল্লাহর স্ত্রী আসমাউল হোসনা (২৩), আরাকান রাজ্যের ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর, মোসাম্মত শাহিনা (২২) ও ১৭ বছর বয়সী কিশোরী। তাদের মধ্যে মনিরুজ্জামান সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমি পল্লী এলাকায় ভাড়া থাকতেন। আর সলিমুল্লাহ, মোসাম্মত শাহিনা ও ১৭ বছর বয়সী কিশোরী কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকতেন। গ্রেপ্তারকৃত সদস্যরা নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে নাশকতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ ঘটনায় র্যাবের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে পৃথক দুটি মামলা করা হয়।
মামলা সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: মঈনুদ্দিন কাদির আদালতে আসামিদের হাজির করে দুই মামলায় ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত ৫ দিন করে মোট ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গ্রেপ্তার বাকি ৪ জন নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন করা হয়নি। আতাউল্লাহ আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে খুনের নির্দেশদাতা ছিলেন। এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ৪ আসামি আদালতের জবানবন্দিতে জানিয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মাদক বিরোধী যৌথ অভিযানে ডিজিএফআই কর্মকর্তা (স্কোয়াড্রন লিডার) রিজওয়ান রুশদী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ভুক্ত আসামি আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শাহীনুর আলম জানান, গ্রেপ্তার ১০ জনকে থানায় হস্তান্তর করেছে র্যাব। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার জানান, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরসা প্রধান আতাউল্লাহসহ ১০ জনকে আটক করে থানায় হস্তান্তর করেছে র্যাব। তাদের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো: কাইউম খান বলেন, এ ১০ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইন ও ফরেন অ্যাক্ট আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। তাদের আগমন ও অবস্থান সম্পর্কে জানতে ৬ জনকে পৃথক দুটি মামলায় ৫ দিন করে মোট ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে মিয়ানমার ভিত্তিক স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হর্সি বলেন, আতা উল্লাহ খুব ক্যারিশমাটিক। সে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। এমনভাবে কথা বলে যেন রোহিঙ্গাদের কষ্ট অনুভব করতে পারছে তিনি।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ৩০ বছর বয়সে সে একটি বিদ্রোহী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। শুরুতে এ সংগঠনের অল্প কয়েকটি বন্দুক ছিল, বেশিরভাগ সময় লাঠি ও ছুরি হাতে হামলা চালাত তারা। পরবর্তিতে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র আসতে থাকে তাদের হাতে।
আরসা প্রধান আতাউল্লাহ: আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী। পুরো নাম আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী। জন্ম ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের করাচি শহরে। বাবা গোলাম শরীফ। তার বাবা করাচিতে দারুল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশোনার পর পরিবারসহ সৌদি আরব পাড়ি দেয়। তারা বাবার সাথে ৬ বছর বয়সে চলে যান সৌদি আরবের রিয়াদে। সেখানে শিক্ষকতা শুরু করে তার বাবা। এরপর এক বিত্তশালী পরিবারের নজরে আসে আতাউল্লাহ। সে পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অষ্টম তিনি। আতাউল্লাহ ইসলামি শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা করেন মক্কা ও রিয়াদে। পরে সৌদি আরব থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে পাকিস্তানে ফিরে যায় আতাউল্লাহ। এরপর রাখাইন গিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়।
২০১৩ সালে গড়ে তোলে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা)। তখন থেকে আরসা প্রধান হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে তীব্র লড়াই চালিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠির সমর্থকদের কাছে এ আতাউল্লাহ নিজেকে একজন ‘মুক্তিকামী সৈনিক’ হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি সৌদি আরবের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে লড়াইয়ে নামেন। তার বেপরোয়া সিদ্ধান্তে বিদ্রোহের কারণে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জীবন বিপর্যস্ত। ফলে তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য অভিশাপ।
অভিযোগ রয়েছে তিনি মিয়ানমার জান্তা সরকারের সৃষ্টি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালায় আরসা। ফলাফল স্বরূপ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর দমন পীড়ন অভিযান। এর জেরে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা।