জবভ: উধঃব:৯ অক্টোবর ২০২৪
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে সংঘটিত পাহাড়ি বিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ওপর
ইউপিডিএফের মানবাধিকার পরিবীক্ষণ সেলের প্রতিবেদন
গত ১ অক্টোবর ২০২৪ খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর এক পাহাড়ি ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানার গণপিটুনিতে মৃত্যুর পর খাগড়াছড়িতে যে পাহাড়ি বিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউপিডিএফের মানবাধিকার পরিবীক্ষণ সেল।
আজ ৯ অক্টোবর ২০২৪ বুধবার প্রকাশিত উক্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ১ অক্টোবর ২০২৪ খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক (সিভিল কন্সট্রাকশন অ্যান্ড সেফটি বিভাগের ইন্সট্রাক্টর) আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানা কর্তৃক ৭ম শ্রেণীর এক পাহাড়ি (ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের) শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের পিটুনিতে আহত হয়ে পরে ওই শিক্ষকের মৃত্যু ঘটে। এরপর তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ, উপজেলা পরিষদ এলাকা, শহরের মহাজন পাড়া ও পানখাইয়া পাড়া এলাকায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযাগ করে। এতে অন্তত ৬ জন পাহাড়ি আহত হন। হামলাকারীরা পাহাড়িদের অন্তত ৩০টি ও বাঙালি-হিন্দুদের ৭টি দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে মালপত্র পুড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধম্ূির্ত ও চীবর বিক্রির দোকান, যেখানে বিক্রির জন্য রাখা বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেয়া হয়। হামলায় একটি বেসরকারি হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বসাকুল্যে এ হামলায় আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১৩ কোটি টাকারও বেশি।
এতে বলা হয়, ইতিপূর্বে ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি একই প্রতিষ্ঠানের ১০ম শ্রেণীর এক পাহাড়ি ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ পুলিশ সোহেল রানাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়েছিল। সে সময়ও তাকে টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে অপসারণসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এরপরও জেল থেকে জামিনে মুক্তির পর শিক্ষার্থীদের দাবি অগ্রাহ্য করে তাকে পুনরায় টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তার এই পুনঃনিয়োগ মেনে নেয়নি। গত ৫ সেপ্টেম্বর সোহেল রানার পুনঃনিয়োগ বাতিলের দাবিতে টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
খাগড়াছড়ির বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৭ অক্টোবর অন্তর্বতীর্কালীন সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা খাগড়াছড়িতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মহাজনাপাড়া এলাকা পরিদর্শন করেন। স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারির ২৪ ঘন্টা পর ২ অক্টোবর বিকাল ৩টায় তা প্রত্যাহার করেছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পাহাড়িরা খাগড়াছড়ির মূল বাজারে যেতে ভয় পাচ্ছেন। হামলার আশঙ্কায় অনেক গ্রামে রাত জেগে পাহারা দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রতিবেদনে কয়েকটি মন্তব্যে বলা হয়-
এক। শিক্ষার্থীদের দাবি অগ্রাহ্য করে অভিযুক্ত ধর্ষক সোহেল রানাকে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে পুনর্বহাল থেকে শুরু করে গণপিঠুনিতে তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পর্যন্ত প্রতি পদে প্রশাসনের ভুল লক্ষ্য করা যায়। এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে সমতলেও ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। খাগড়াছড়িতে “শাস্তিমূলক বদলির” পরও তার কোন শিক্ষা হয়নি; বরং সহজ-সরল পাহাড়ি ছাত্রীদের মধ্যে তিনি তার সহজ শিকার পেয়ে যান। দশম শ্রেণীর এক পাহাড়ি শিক্ষার্থীর ওপর যৌন হামলা চালানোর অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। জেল থেকে জামিনে বের হওয়ার পর তাকে আবার স্বপদে পুনর্বহাল করা হয়। তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ার দাবি উঠলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। কেবল পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা নয়, অনেক বাঙালি শিক্ষার্থীও তার আচরণে ক্ষুদ্ধ ছিল। কলেজ প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আমলে নিয়ে সোহেল রানার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতো, তাহলে তাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।
দুই। কলেজ কর্তৃপক্ষের দ্বিতীয় ভুল হলো ঘটনার দিন সোহেল রানাকে দ্রুত পুলিশের হাতে সোপর্দ না করে তাকে রক্ষার চেষ্টা করা। এতে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় অধ্যক্ষের পলায়ন পরিস্থিতিকে আরো বেশি জটিল করে তোলে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
তিন। অপরদিকে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে তড়িৎ পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক রূপ গ্রহণ করতো না। প্রত্যক্ষদশীর্দের বণনা অনুযায়ী, খেজুর বাগান (উপজেলা পরিষদ এলাকা) এলাকায় সেনা সদস্যরা আসার পরই বাঙালি শিক্ষার্থীরা পাহাড়িদের ওপর হামলা শুরু করেছিল। এখানে আরও প্রশ্ন হলো প্রতিবার হামলা-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চলতে থাকার অনেক্ষণ পরই কেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়? তার আগে যথাসময়ে কেন তারা উপস্থিত হতে পারে না? এমনকি তাদের উপস্থিতিতেও কীভাবে দাঙ্গাকারীরা হামলা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ চালাতে পারে? তাদের হাতে থাকা ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার কেন তারা দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে না? ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা রোধ করতে হলে এসব প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে ৫টি দাবি তুলে ধরা হয়েছে। দাবিগুলো হলো:
ক) খেজুর বাগান (টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ-উপজেলা পরিষদ এলাকা), মহাজনপাড়া ও পানখাইয়া পাড়া এলাকায় হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার পাঁচ গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
খ) হামলার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের জন্য পাহাড়ি-বাঙালি সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী গণ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
গ) আহতদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত ও যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ঘ) ভবিষ্যতে যাতে কোন ঘটনা পাহাড়ি বিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নিতে না পারে তার জন্য প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে ও আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে; এছাড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
ঙ) অভিযুক্ত ধর্ষক সোহেল রানার গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে এবং এ ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের কোন গাফিলতি ও তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল কী না তাও তদন্ত করতে হবে।
এছাড়া প্রতিবেদনে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
বার্তা প্রেরক
নিরন চাকমা
প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ
ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)