পযর্টন ডেস্ক: লক্ষ্মীপুর শখের ঘোরাঘুরিতে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের খুব জমবে মজা। ভোরবেলা শহর দেখতে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটাহাটি। আর সন্ধ্যার পর এগলি ওগলি ঢু মেরে চায়ের আড্ডা করা। ভ্রমণের শেষ মূহুর্তে প্রায় ৪ শত বছরের ইতিহাসের টানে অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা দালাল বাজার জমিদার বাড়ি আর তার নৃত্যশালার স্মৃতির টানে লক্ষ্মী প্রিয়ার জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে কল্পনার জগতের মত ১৭ শতক জায়গায় উপর নির্মিত রোদ-বৃষ্টি পেরিয়ে এক যাযাবর অতিথি এখন জমিদার লক্ষ্মী নারায়নের জমিদার বাড়ি। তার পুত্র ব্রজবল্লভ রায় নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতায় দারুণভাবে সফল। আর নাতি পুত্র গৌর কিশোরকে লেখাপড়া করিয়েছেন কলকাতায়। আর ছেলের বউ এনেছেন সেতারের সুরের মতো মিষ্টি মেয়ে লক্ষ্মী প্রিয়াকে। এ প্রিয়ংবদার নামে নামকরণ হয়েছে এ নগরী ও জমিদার লক্ষ্মী নারায়নের জমিদার বাড়ি। লক্ষ্মী প্রিয়ার জমিদার বাড়ির সিঁড়ি পেরিয়ে অন্দরমহলের বারান্দায় পা রাখতে রাজ তোরণ পেরিয়ে নজর কাড়ে রাজপ্রাসাদ, জমিদার প্রাসাদ ও অন্দরমহল। পাশে বাঁধানো ঘাট, নাট মন্দির, পূজামণ্ডপ, উঁচু ভীম ও বাড়ির প্রাচীর। একটু এগোলে সুন্দর ব্যালকনির নিচে থাম পেরিয়ে বিশাল একতলা বাড়ি। সে বাড়িতে ঢুকতে আরও একটা বড় দারাজ পেরুতে হয়। সে দারাজের কারুকার্য বলে দেয় বাড়ির মালিক কতটা নান্দনিক। অর্থের যে অভাব নেই তা বাড়ির সাজ-সজ্জা দেখলে বোঝা যায়। বাড়ির বাঁকানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর পাওয়া যাবে সুন্দর সাজানো গোছানো বারান্দা ও তার পাশে মাহফিলখানা। বাড়ির মনিব জমিদার লক্ষ্মী নারায়ন অন্দরমহলে বাস করেন। পাশের ঘরগুলোতে থাকে কর্মী, ভৃত্য আর পোষ্যরা।
এ যেন ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের এক কল্পনার জগৎ। সে ঘরগুলোর সামনে বেশ বড় বাগান। সে বাগান থেকে ভেসে আসে নূপুরের শব্দ। কল্পনা থেকে চোখ মেলতে দর্শনার্থী নারী-পুরুষ ঘুরে ঘুরে দেখছেন জমিদার বাড়ির অন্দরমহল ও বসে গল্প করছেন পুকুর ঘাটে। সে দৃশ্যে কল্পনায় সন্ধ্যা নামে বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে নূপুরের আওয়াজ। গভীর রাত পর্যন্ত চলবে এ আওয়াজে নাচ গানের আসর। সে আয়োজনের সুমধুর আওয়াজে পুরো এলাকা হবে মুখরিত। সারেঙ্গী সেতারের মিষ্টি সুর বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। আসরে আমন্ত্রিত অতিথিরা ফুল ভালোবাসে দেখে হরেক রকমের ফুল নিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে ফুলওয়ালা। পানওয়ালা পান সাজিয়ে বসে আছে। এগুলো কোন সাধারণ পান নয়। জাফরান ও গোলাপজলে ভিজিয়ে রাখার পরে এ পানগুলো দিয়ে খিলি বানানো হয়। আর খিলি বানানোর সময় মিশিয়ে দেওয়া হয় অল্প আফিম। নৃত্য ও আফিমের নেশার থেকে সদ্য ‘রাজা’ উপাধি পাওয়া জমিদার পুত্র গৌরকিশোরের বেশি আকর্ষণ তার স্ত্রী লক্ষ্মী প্রিয়ার প্রতি। সাজানো গোছানো জমিদার বাড়িটি দেখলে এ লক্ষ্মী প্রিয়ার নান্দনিক রুচির পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বিলুপ্তির পর এ জমিদার পরিবারটির শৌর্য-বীর্য কমতে থাকে। তার পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারা এ বাড়িতে থেকে নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। পরে ধীরে ধীরে তারা ভারত ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যান। তার পর থেকে এ যাযাবরের কল্পনা আর ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে ঘাট বাঁধানো পুকুর, উঁচু উঁচু প্রাচীর ঘেরা নান্দনিক কারুকাজের দালান, নৃত্যশালাসহ নানা স্থাপনা লক্ষ্মী নারায়নের জমিদার বাড়ি। আর তা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে বেড়াতে আসেন ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক। দীর্ঘদিনের পরিত্যাক্ততা আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সংস্কার না হওয়ায় জমিদারি প্রথার স্মৃতিচিহ্ন গায়ে মেখে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি হয়ে আছে জেলার ঐতিহ্য স্থাপত্য শিল্প লক্ষ্মী নারায়নের জমিদার বাড়ি। লক্ষ্মী প্রিয়ার প্রিয় বাড়িটির বিভিন্ন ভবনের দেয়াল এখন ধসে গেছে। ইটের স্তর ভেদ করে কোথাও গজিয়েছে বিশালাকার পরজীবী গাছ। কোনো কোনো ভবনের উপরিভাগ ক্ষয়ে গেছে। অথচ কতগুলো দিন সন্ধ্যাবেলায় এ বাড়িতে সন্ধ্যাপূজোর প্রার্থনাতে দীর্ঘতা কামনা করেছেন লক্ষ্মী প্রিয়া।
জানা যায়, আনুমানিক ৪ শত বছর আগে যে লক্ষ্মী নারায়ণ কাপড়ের ব্যবসা করতে লক্ষ্মীপুরে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে তার বংশধরেরা জমিদারি করে গেছেন এ এলাকায়। আর এসব চরিত্রের মধ্যে মধ্যমণি যে বসে আছে তার নাম লক্ষ্মী প্রিয়া। নিঃসন্তান এ জমিদার দম্পতি রাজা-রানী হওয়া সত্ত্বেও তাদের দুঃখের শেষ ছিল না। সে দুঃখ লাঘব করার জন্য ঢাকার বিক্রমপুর থেকে গোবিন্দ কিশোর নামের এক ছেলেকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন এবং সুযোগ্য সন্তান হিসেবে গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে গোবিন্দ কিশোরের তিন পুত্র ছিল তারা শৈলেন্দ্র কুমার রায়, সত্যেন্দ্র কুমার রায় ও নবীন কিশোর রায়। এ তিন ভাই জমিদারি দেখাশোনা করলেও মূলত নবীন কিশোর ছিলেন মুখ্য জমিদার।
এলাকাবাসীরা জানান, জমিদার বাড়িটির এমন ভগ্নদশা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থী ও পর্যটক আসছে। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সহজে এখানে আসা যায়। তবে ধসে পড়েছে কোনো কোনো ভবনের দেয়াল। কোনোটিতে দেখা দিয়েছে ফাটল। জরাজীর্ণ এসব ভবন যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন এ পুরনো জমিদার বাড়িটে দেখাশোনা করছে। জমিদার বাড়ির তিনদিকে সান বাঁধানো তিনটি পুকুর। সংস্কারের অভাবে এসবের সব জরাজীর্ণ। এজন্য একটু মন খারাপ হয়ে গেলেও বাড়িটির চারপাশে নানা ফলের গাছ দেখে মন ভালো হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় আরও কিছু সময় এখানে পেরিয়ে যাক। সে সব ইতিহাস ফেলে উঠতে ইচ্ছে করে না। তবুও রেখে ফিরতে হয় ব্যস্ত নগরীর উদ্দেশ্যে। পেছনে পড়ে থাকে অন্দর মহলের বাইজী ঘরসহ আরও কত জানা অজানা গল্প আর লক্ষ্মী প্রিয়ার পিছুটান।