জাতীয় ডেস্ক: গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (৬ অক্টোবর) বিকেল ৪ টায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে। এ সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের ৭৮ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান ও যুক্তরাজ্য সফরের নানা দিক তুলে ধরা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার পর হঠাৎ অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সবার মাতামাতিকে সন্দেহ হয় মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গতিকে থামিয়ে ১৯৭৫-৯৬, ২০০১-০৮ এ ২৯ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দেশকে কি দিয়েছে। মানুষের ভাতের ব্যবস্থা করতে পেরেছে, পারেনি; দুর্ভিক্ষ ছিল। সব সময় উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষ লেগে থাকত। দক্ষিণে মানুষ তখন এক বেলা খাবার জোটাতে পারত না। ছেঁড়া কাপড় পরে থাকত, বিদেশ থেকে পুরাতন কাপড় এনে পরানো হতো। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টিহীনতা প্রতিনিয়ত ছিল। এখন বাংলাদেশের মানুষ যতটুকু পাচ্ছে, সেটা আওয়ামী লীগ এবং আমরা ক্ষমতায় আসার পর উন্নতিটা হচ্ছে। তারপরে এত প্রশ্ন আসে কেন, সেটা আমার কথা। এখন একটা দেশ এত দ্রুত উন্নতি করেছে, সেটা মানুষের মাথাব্যথা হয়ে গেল কি না। সেটাকে এখন কীভাবে নষ্ট করা যায়, এ সন্দেহটা আমার আছে। তিনি আরও বলেন, আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশ আমার দেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, যখন মিলিটারি ডিক্টেটর ছিল, যখন আমরা সংগ্রাম করেছি, জনগণের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের জন্যসংগ্রাম করেছি। আমরা স্লোগান দিয়েছি আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব এবং নির্বাচনের যে সংস্কারগুলো ছবিসহ ভোটার তালিকা, ব্যালট বাক্স, নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশন যেটা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেটাকে আলাদা করে দিয়ে, বাজেট আলাদা করে দিয়ে, তাদের আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। জনগণের মধ্যে ভোটের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে জনগণের ক্ষমতাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সে ক্ষমতাকে বের করে আমরা তো এনেছি। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের জোট আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করে এটা করেছি এবং এর জন্য আমাদের বহু মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে। আমি সে কথাটা মানুষকে বলেছি, আমাকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন শেখাতে হবে না। বাংলাদেশে মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের যে আন্দোলন, সেটা আমরা করেছি। সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও নির্বাচন হয়েছে। জনগণ আমাদের বারবার ভোট দিয়েছে ও নির্বাচিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তো আমি তাদের বলেছি। আমরা আব্রাহাম লিংকনের যেটা জানি, গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। গভর্মেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল এটা তো আমরা এস্টাবলিশড করেছি। গভর্নমেন্ট ফর দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি থেকে তো আমরা রেহাই দিয়েছি। আমাদের সেনাবাহিনীসহ কত মানুষকে হত্যা করেছে। বিমান বাহিনীর কত অফিসারকে হত্যা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর কি অকথ্য নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। যারা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, মানি লন্ডারিং ও যত কর্ম-অপকর্ম ছিল সেগুলো থেকে মুক্ত করেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেশন জট ছিল, সেটা থেকে আমরা উদ্ধার করেছি। এ সব করে যখন একটা নিয়মতান্ত্রিক দেশ পরিচালনা করছি এবং দেশটা যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলেছে, তখন হঠাৎ অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সবার এত মাতামাতি কেন আমার সন্দেহ হয়। তিনি বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের নিজেদের একটা দোষ আছে। আমাদের দেশে কিছু লোক নির্বাচন নিয়ে বেশি কথা বলি। যারা নির্বাচনকে বয়কট করেছে, কলুষিত করেছে, ভোট চুরি করেছে, ভোট ডাকাতি করেছে তাদের কাছ থেকে শুনতে হয় অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা। এটা হচ্ছে দুর্ভাগ্য। ২০০৮ সালে যখন অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হলো, যে নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ২৯ টি সিট। তাদের আবার বিএনপি-জামায়াত ২০ দলীয় ঐক্য জোট, পরে আরেকটা সিট বেড়ে হয়েছিল ৩০ টা। ২০১৪ নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে তারা অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ হত্যা এবং এমন কোনো অপকর্ম নাই করেনি। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনে ৭০০ নমিনেশন দিয়ে নিজেরা মারামারি করে নির্বাচন থেকে সরে গেল। সরে গিয়ে নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করল। এখন তাদের মুখে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনি এবং তা সব জায়গায় প্রচার করে বেড়াচ্ছে। আসল কথা নির্বাচনটাকে বানচাল করে দেওয়া। ক্ষমতায় থেকে এত মানিলন্ডারিং করেছে, এত বেশি টাকার মালিক হয়ে গেছে, তারা অবাধে সে টাকা খরচ করে যাচ্ছে। সব জায়গায় একটা প্রচার অর্থাৎ তারা ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভোটের জন্য তো আমরা সংগ্রাম করলাম, আমাকে ভোটের হিসাব শেখাতে হবে না। আমরা সে আইয়ুব খানের আমল থেকে আন্দোলন করে রাস্তায় থাকি। আমরা এমন না যে নতুন এসেছি। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া সব তো ভোট চোর। আওয়ামী লীগ আসার পর আওয়ামী লীগের ভোট চুরি করতে হয়নি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। কাজের মধ্য দিয়ে আমরা মানুষের আস্থা অর্জন করি। আর এ দেশের মানুষ এখন জানে নৌকায় ভোট দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। নৌকায় ভোট দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি পেয়েছে। নৌকায় ভোট দিয়ে মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন ৪১ ভাগ থেকে ১৮ ভাগে নামিয়ে এনেছি। এটা কারো এনজিও মাধ্যমে হয়নি, কারো ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে হয়নি। বরং আমরা ক্ষুদ্র সঞ্চয় করাচ্ছি। আমরা দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে এনেছি, বর্তমানে দেশে হতদরিদ্র মাত্র পাঁচ পার্সেন্ট। ইনশাআল্লাহ ওটুকু থাকবে না। হতদরিদ্র থাকবে না। এখন একটা সন্দেহের বিষয় আছে, আমাদের মানুষ কতটুকু সচেতন সেটা হলো কথা। তবে কিছু লোক তো আছে, যারা চোখ থাকতে অন্ধ এবং কান থাকতে বধির।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা সংস্থার ওপর স্যাংশন দেবে, আবার তাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা চাইবে এটা আবার কেমন কথা। আমি সে প্রশ্নটা করেছি। নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের অভিযোগ প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য করেন তিনি। আমেরিকায় যিনি অ্যাম্বাসেডর আছেন, তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আমেরিকা সরকার থেকে আমার অ্যাম্বাসেডরকে কি ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তার তথ্য মতে শুধু আমাদের এম্বাসিতে তারা কিছু নিরাপত্তা দেয়। তখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তথ্য দিলেন আমরা তো আমেরিকা এম্বাসিতে নিরাপত্তার জন্য ১৫৮ জন পুলিশকে ডিপ্লয় করেছি এবং এখানে যে অ্যাম্বাসেডর আছে তার জন্য সিভিল ড্রেসে গানম্যান দেওয়া আছে। কাজে এখানে তার নিরাপত্তার তো এমন কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের পুলিশ দরকার এখন সারা দেশের জন্য। কাজে সেটা উইড্র করা হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে তো গানম্যান দেওয়া আছে। এছাড়া তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যবস্থা কিন্তু অ্যাম্বাসির ভেতর আছে। এটা নিয়ে বারবার প্রশ্ন হচ্ছে, কিন্তু এটার কোনো অর্থ নেই। আমার অ্যাম্বাসেডর তো কোনো নিরাপত্তা পায় না। তিনি আরও বলেন, আমেরিকাতে প্রতিদিন গুলি হয়। স্কুলে গুলি, শপিংমলে গুলি, খাবার দোকানে গুলি, বাড়ির ভেতরে গিয়ে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলে। আমরা তো এমনিতে শঙ্কায় থাকি আমাদের দেশের মানুষদের নিয়ে। বাঙালি এক মহিলা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তাকে ছুরি মারা হলো। একজন মুক্তিযোদ্ধা মসজিদ থেকে ফিরছিল তাকে গুলি করে মারা হলো। আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্টকে মারল। যত্রতত্র গোলাগুলি তাদের নিজেদের দেশ তো তাদের নিজেদের সামাল দেওয়া উচিত। ওখানে নিরাপত্তা সমস্যা, আমাদের দেশে তো নিরাপত্তা সমস্যা নেই। আমরা সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদকে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়েছি। অন্তত সেটি তো এখন আমরা কয়েক বছর ধরে রাখতে পেরেছি। আমাদের যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তারা অনেক ভালো কাজ করছে।
ওয়েজবোর্ড কার্যকর করার দায়িত্ব মিডিয়া মালিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শুধু নিজেরা পয়সা কামালে হবে না, যাদেরকে দিয়ে কাজ করাবেন সাংবাদিকদের ভালো মন্দ তো দেখতে হবে। ওয়েজবোর্ড আমরা দিয়েছি, এটা কার্যকর করার দায়িত্ব মিডিয়া মালিকদের। ওয়েজবোর্ড কার্যকর করে দিয়েন। সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের জন্য সার্ভিস দিয়ে থাকে, কাজ করে। তাদের ভালো-মন্দ দেখতে হবে। মালিকদের আবার কমিটি আছে, তারা আবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু মেসেজ দেওয়ার আমরা দেব। এখানে মালিকদের যা করার তা করা উচিত। তিনি আরও বলেন, আমি ৯৬ সালে সরকারে এসে টেলিভিশন, রেডিও সব বেসরকারি খাত উন্মুক্ত করে দেই। উন্মুক্ত করে শুধু সাংবাদিক না, শিল্পী, সাহিত্যিক, টেকনিশিয়ানসহ অনেকে কাজের সুযোগ পেয়েছে। একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে অধিবেশন শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে পৌঁছান তিনি। দুই দেশে মোট ১৬ দিনের সফর শেষে বুধবার (৪ অক্টোবর) দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।